কাক পরীর রূপকথা (পর্ব- ২) - তুরস্ক রূপকথা - (অনুবাদ : মিথিল ভট্টাচার্য্য)

কাক পরীর রূপকথা
তুরস্ক রূপকথা
অনুবাদ - মিথিল ভট্টাচার্য্য




পর্ব- ২ ।।

অনেক ভেবেচিন্তে একদিন সে রাজাকে গিয়ে বলল, “মহারাজ এত সুন্দর পাখি, তার গায়ে রঙের এমন বাহার! অমন গজদন্তের দাঁড়। অথচ পাখি ডাকেও না নাচেও না! এ কেমন কথা!”
রাজা অবাক হয়ে বললেন “সত্যি তো! পাখি ডাকে না, নাচে না, চুপচাপ দাঁড়ে বসে থাকে কেন?”
- এমিলকে ডেকেই জেনে নিন না ?”
- এমিল বনের শিকারী সে কিভাবে জানবে একথা ?
- আহা সে না জানুক, পাখির আগের মালিক তো জানবে। এত সুন্দর বিদেশী পাখি, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই একে পুষেছিল। এমিলকে বলুন না পাখির মালিকের নাম জেনে আসতে। “
- ওহ বেচারা ছেলেমানুষ, ও কী আর পারবে ?
- কী যে বলেন মহারাজ, যে ছেলে এত সুন্দর পাখি, এত দামী গজদন্ত এনে দিতে পারে, সে আর এইটুকু পারবে না? চিন্তা করবেন না আমিই ওকে ডেকে পাঠাচ্ছি।“
মন্ত্রী এমিলকে ডেকে পাঠিয়ে বলে উঠলেন “এমিল তোমাকে মহারাজের আর একটা কাজ করে দিতে হবে ?”
এমিল হাসিমুখে বলে উঠল “বলুন কী আদেশ?”
মন্ত্রী বাঁকা হাসি হেসে বলে ওঠে “বলি এত সুন্দর পাখি তো ধরে দিয়েছ, কিন্তু সে পাখি নাচে না কেন ? ডাকে না কেন? এর আগের মালিককে শুধোতে হবে। তার খোঁজ নিয়ে এস।“
এমিল অবাক হয়ে বলে উঠল “আগের মালিকের খোঁজ আমি কীভাবে পাব?”
- সে জানি না, মহারাজের আদেশ, যেখান থেকে পারো, তার নাম জেনে আস। নইলে দেশের নিয়ম মত গর্দান যাবে।“
এমিল আর কী করবে, কালো মুখে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়লো। বনের মাঝে ঘুরতে সেই পুরোন গাছতলাতেই এসে বসতেই কোত্থেকে জানি সেই কাকটা এসে আবার বলে উঠল “কী গো এমিল, মুখ ভার কেন ? আবার কী হয়েছে?
এমিল সব কথা খুলে বলল কাককে।
কাক চিন্তিত স্বরে বলে উঠল “পাখির মালিকের নাম আমি জানি। কিন্তু সেই নাম রাজাকে বললে তিনি হয়ত কষ্ট পেতে পারেন। তবু তিনি যখন জানতে চান তখন তার কাছে গিয়ে বলো পাখির মালিকের নাম ‘রাজকন্যা জেইনিপ’ “
এমিল অবাক হয়ে বলে উঠল “রাজকন্যা জেইনিপ? সে কে? আর রাজামশাই তার নাম শুনে কষ্ট পাবেন কেন ?”
পাখি বলে উঠল “সে তোমার জেনে কাজ নেই। তোমাকে যা বলতে বলেছি তুমি তাই করো। রাজাকে গিয়ে জানাও পাখির মালিকের নাম। কিন্তু সাবধান, রাজা যখন একা থাকবে তখনই শুধু বলো এই নাম, নইলে কিন্তু বড় ভয়ংকর কাজ তোমার কাঁধে নেমে আসতে পারে। সে কাজ বড় কঠিন।“
এমিল ভ্যাবাচ্যাকার মতন কাকের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ফিরে আসে রাজপ্রাসাদে। মহারাজ বেসিমের কাছে এসে বিনীত স্বরে সে বলে উঠল “মহারাজ পাখির মালিকের নাম আমি জেনেছি, কিন্তু...”
মহারাজ বেসিম উদগ্রীব হয়ে বলে উঠল “কিন্তু কী এমিল ?”
-মহারাজ সেই নাম আমি আপনাকে একা বলতে চাই।
মহারাজ কিছু বলে ওঠার আগেই মন্ত্রী বুলুত আগ বাড়িয়ে বলে উঠল “আমি মহারাজের সব থেকে কাছের মানুষ। রাজ্যের সব খবর আমাকেই রাখতে হয়, তোমার যা বলার আমার সামনেই বলো।“
এমিল অপ্রস্তুতের মতন মহারাজের দিকে তাকিয়ে থাকল।
রাজা বেসিমও হেসে বলে উঠল “তুমি মন্ত্রীমশাইয়ের সামনেই যা বলার বলতে পারো এমিল। উনি আমার বাবার আমলের লোক, আমি ওনার কাছ থেকে কিছুই লুকোই না।“
অগত্যা এমিল এক গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে উঠল “মহারাজ পাখির আগের মালিকের নাম হল রাজকন্যা জেইনিপ।“
হঠাৎ করে রাজার মুখটা যেন কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়, তার ঠোঁট দুটো কিছু বলতে গিয়েও যেন কেঁপে ওঠে। কিছু সময় পর তার দুই চোখ বেয়ে দরদর করে নেমে আসে নোনা জলের রেখা।
অবাক এমিল রাজার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ মন্ত্রী বুলুত গর্জন করে ওঠে “তোমার এত সাহস? রাজকন্যা জেইনিপের নাম নাও তুমি মহারাজের সামনে। সেপাইরা কোথাও আছ, একে কারাগারে নিয়ে যাও।“
হতভম্ব এমিল কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাজা বেসিম ভাঙা স্বরে বলে ওঠে “না তার কোন প্রয়োজন নেই মন্ত্রীমশাই। এমিল সরল ছেলে, ও কী ভাবে জানবে রাজকন্যা জেইনিপের গল্প। ওর কোন দোষ নেই এতে।“
- কিন্তু মহারাজ?
- না মন্ত্রীমশাই এমিল নিরপরাধ, ওকে মাপ করে দিন।“
অবাক এমিল এবার কোনমতে সাহস জুগিয়ে বলে উঠল “এই রাজকন্যা জেইনিপ কে মহারাজ? কেন তার নাম শুনে আপনি এতটা ভেঙে পড়ছেন আজ ?”
মন্ত্রী দাঁত কড়মড় করে উঠে, কিন্তু কিছু বলার আগেই  মহারাজ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠেন “ শুনবে সেই গল্প? আজ অব্দি খুব কম লোকেই জানে সে কথা, কাউকেই আমি জানাতে চাই না সেই কাহিনী। কিন্তু তোমাকে আমি আমার বন্ধু মেনেছি এমিল, তাই তোমাকে বলতে বাধা নেই। শোন তবে
আজ থেকে ছয় সাত বছর আগের কথা, আমি তখন তোমার বয়সীই হবো। একদিন সমুদ্র পথে ময়ূরপঙ্খী জাহাজে করে বেরিয়ে পড়েছিলাম দেশ ভ্রমনে। হঠাৎ এক পূর্ণিমার রাতে জাহাজ গিয়ে পড়ল ঝড়ের মুখে, মাঝি লস্কর সব নিয়ে জাহাজ  প্রায় ডুবে যায় আর কী, আচমকা এক বিরাট ঢেউয়ের ধাক্কায় আমি জাহাজ থেকে গিয়ে ছিটকে গিয়ে পড়লাম সমুদ্রের বুকে। আরেকটু হলেই ডুবে মরতুম, কিন্তু ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্না ছিলেন তাই একটা গাছের মোটা গুঁড়ি হাতে এসে ঠেকল। তাই ধরে ভাসতে ভাসতে এসে পৌছালাম ছোট্ট একটা দ্বীপের বুকে।
ক্লান্ত শরীরে সেই দ্বীপের এক গাছতলায় অচেতন হয়ে পড়ে আছি, হঠাৎ এক মিষ্টি হাসির সুরে আমার ঘুম ভেঙে যায়, দেখি রামধনু বেয়ে নেমে এসেছে ভারী সুন্দরী একটি মেয়ে। তার পিঠে প্রজাপ্রতির মতন অপূর্ব দুটি ডানা, আমার দিকেই তাকিয়ে সে ভারি মিঠে সুরে হাসছে।
সে ইশারায় আমাকে তার পানে ডাকছে, আমি আর সব কিছু ভুলে তার পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম ঐ রামধনুর দিকে। তারপর কীভাবে যে সেই রামধনু বেয়ে তার মায়াবী দুনিয়ায়, পরীরাজ্যে গিয়ে পৌছালাম কে জানে!
এমিল হতভম্ব হয়ে বলে ওঠে “পরীরাজ্য মহারাজ?”
- হ্যাঁ এমিল পরীরাজ্য, যেখানে যাওয়ার স্বপ্ন সবাই দেখে, কিন্তু খুউব কম মানুষেরই তার মাটিতে পা রাখার সৌভাগ্য হয়। আর আমি তাদের মধ্যে একজন। আর সে মেয়েটি আমাকে সেই রাজ্যে নিয়ে গেছিল সেই হলো রাজকন্যা জেইনিপ। পরীরাজ্যের রাজকুমারী।
একটি মাস আমি কাটিয়েছিলাম সেই অপার্থিব রাজ্যে, আর তার মধ্যে আমার দুজনেই দুজনকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলি। কিন্তু এক মাস পর সব স্বপ্নের শেষ হয়, আমাকেও তাকে চিরদিনের মতন ঐ পরীরাজ্যেই পেছনে ফেলে এসে ফিরে আসতে হয় এই দেশে।“
এমিল ব্যাকুল হয়ে বলে ওঠে “কিন্তু কেন মহারাজ, আপনি রাজকন্যাকে কেন সাথে করে নিয়ে আসেননি?”
- উপায় ছিল না এমিল, আমি তাকে অনেকবার বলেছিলাম। কিন্তু সেই ফিরিয়ে দিয়েছিল আমার প্রস্তাব। বারবার শুধু একটাই কথা বলেছিল, বাধা আছে। সে আমার সাথে পরীরাজ্য ত্যাগ করতে গেলে হয়ত আমাদের দুজনকেই মরতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে শেষমেষ তার ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে আমি ফিরে আসি নিজের দেশে।
তুমি আমাকে আগে প্রশ্ন করেছিলে কেন আমি সব সময় উদাস থাকি, রাজকার্যে কেন আমার মন নেই? তার কারণ এই এমিল। আমি কিছুতেই জেইনিপকে ভুলতে পারি না। তার স্মৃতি আমাকে সব সময় তাড়া করে বেড়ায়। খালি মন বলে যদি আর একটিবার তাকে দুচোখের সামনে দেখতে পারতাম! কেউ যদি তাকে নিয়ে আসতে পারত আমার কাছে!”
এমিল ব্যাকুল হয়ে বলে ওঠে “মহারাজ আমি যাবো রাজকন্যা জেইনিপের খোঁজে। যেই বাধাই আসুক না কেন, আমি সব পেরিয়ে তাকে ঠিক নিয়ে আসব আপনার কাছে।“
রাজা বেসিম উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠে “তুমি জান না, তুমি কী বলছ এমিল, এই কাজ বড় কঠিন। পরীরাজ্যে আমি পৌছেছিলাম ভাগ্যের কৃপায়, কিন্তু সাধারণ মানুষেরা সেই রাজ্যের খোঁজ জন্ম জন্মান্তরেও পায় না। সেখানে সব বাঁধা বিপত্তি এড়িয়ে রাজকন্যাকে নিয়ে আসা এত সহজ নয়, তুমি বিপদে ---“
রাজার কথা শেষ হবার আগেই মন্ত্রী সাত তাড়াতাড়ি বলে ওঠে “কেন পারবে না মহারাজ, পাখি এনে দিল, গজদন্ত যোগাড় করল, রাজকন্যা জেইনিপের নামও জেনে গেল, আর তাকে নিয়ে আসতে পারবে না? দেখে নিন ঠিক পেরে যাবে। যাও বাপু তুমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ো রাজকন্যার খোঁজে। “
রাজা বেসিম বাঁধা দিয়ে বলে উঠল “ এ এত সহজ কাজ নয় মন্ত্রী মশাই। এমিল ছেলে মানুষ এত কঠিন কাজ সে করে উঠতে পারবে না।“
এমিল নিজেই এবার হাসিমুখে বলে ওঠে “পারব কী পারব না জানিনা মহারাজ। কিন্তু আপনার জন্য সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে অন্তত একটিবার চেষ্টা করতে চাই। আপনি আমাকে বারণ করবেন না।“
হতাশ হয়ে মহারাজ বলে উঠলেন “ঠিক আছে তোমার যা ইচ্ছে।“
মন্ত্রী বুলুত বাঁকা সুরে বলে উঠল “রাজ্যের নিয়ম মনে আছে তো এমিল, কাজ পূরণ করতে না পারলে গর্দান।“
এমিল হেসে মাথা নেড়ে রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসে।
আবার সেই গাছের তলায় এমিল ফিরে আসতেই উড়ে আসে সেই কাক, সব শুনে গম্ভীর হয়ে কাক বলে ওঠে “এই ভয়টাই আমি পাচ্ছিলাম এমিল, এই কাজটা এত সহজ নয়। বরং সত্যিই কঠিন, প্রথমত পরী রাজ্যে পৌছান, আর তার উপর রাজকন্যাকে সেই রাজ্য থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসা। বিশেষত তার নিজের অজান্তে!”
এমিল অবাক হয়ে বলে ওঠে “কিন্তু তাঁর অজান্তে কেন ? রাজকন্যা জেইনিপ ও তো মহারাজকে বেসিমকে ভালবাসেন, তাহলে সমস্যা কোথায় ?”
কাক চিন্তিত স্বরে বলে ওঠে “সমস্যা অনেক গভীরে এমিল। রাজা বেসিমকে যখন রাজকন্যা জেইনিপ পরীরাজ্যে সবার চোখ এড়িয়ে নিয়ে আসে, তখন রাজকন্যার এক সখীর ভুলের কারণে সেই খবর রাজপরিবারের সবাই জেনে যায়। পরীরাজ রেগে গিয়ে জেইনিপকে অভিশাপ দেয় যদি সে জেনে বুঝে পরীরাজ্যের সীমানা একবারও পার করে তাহলে সেই মুহূর্তে সে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এবং তাঁর সঙ্গে যে থাকবে তারও একই হাল হবে। এই ভয়েই রাজকন্যা জেইনিপ রাজা বেসিমের সাথে চলে আসতে পারেনি। তাই বুঝতে পারছ যদি তুমি রাজকন্যাকে জানিয়ে এই কীর্তি করতে যাও তাহলে তোমাদের দুজনেরই কী হাল হবে ?”
এমিল ব্যাকুল হয়ে বলে উঠল “তাহলে উপায়?”
- উপায় এমন কোন ফন্দী আঁটতে হবে যাতে রাজকন্যা রাজ্যের সীমানাও পার করে যান অথচ বাকিরা তো দুরস্ত তিনি নিজেও টের না পান। তাহলেই অভিশাপের জাল কেটে তাকে মুক্ত করা যাবে।“
- সে সব তো বুঝলাম, কিন্তু এলিফ তুমি এত কিছু জান কীভাবে ?
কাক একটু বিরক্তির সাথে বলে ওঠে “সে সব জেনে তোমার কি কাজ? অযথা সময় নষ্ট না করে এখন যা বলছি তা শোন।
রাজাকে গিয়ে বলো ভারী সুন্দর এক ময়ূরপঙ্খী নাও দিতে,আর তাঁর সাথে চেয়ে নাও সেই নাও ভর্তি খেলনা পুতুল। তারপর নৌকা করে ভেসে যাও পূব দক্ষিণ দিকে। সাত দিন সাত রাত গেলে অবশেষে সমুদ্রের মাঝে দেখতে পাবে নারকেল ঘেরা এক দ্বীপ। পূর্নিমার রাত্রে সেই দ্বীপে নেমে আসে পরীরা। আর সেই পরীর দলে থাকবে রাজকন্যা জেইনিপও । তোমাকে যেভাবেই হোক তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নৌকায় তুলে তাঁর অজান্তেই দ্বীপের সীমানা পার করে যেতে হবে। ঐ দ্বীপই পরীরাজ্যের শেষ সীমানা। একবার ঐ দ্বীপের মোহনা পার করে যেতে পারলে আর সমস্যা নেই। তখন রাজকন্যা জেইনিপও হয়ে যাবে শাপমুক্ত।“
এমিল মাথা নেড়ে বলে ওঠে “হুম, ভাল ভেবেছ। ঠিক আছে আমি এখনই যাচ্ছি মহারাজের কাছে ময়ূরপঙ্খী নাও আর খেলনা পুতুলের খোঁজে।“
তারপর একদিন রাজার কাছ থেকে ময়ূরপঙ্খী নাও আর নৌকা ভর্তি খেলনা নিয়ে দিনক্ষণ হিসেব করে এমিল বেরিয়ে পড়ল নীল সমুদ্রের বুকে।

Continue ................. 

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.