কাক পরীর রূপকথা (পর্ব- ১) - তুরস্কের রূপকথা - (অনুবাদ : মিথিল ভট্টাচার্য্য)

কাক পরীর রূপকথা।।
তুরস্কের রূপকথা।।
অনুবাদ – মিথিল ভট্টাচার্য্য।।



পর্ব- ১।।
অনেক অনেকদিন আগের কথা, নীল সমুদ্র আর উঁচু আরারাত পাহাড়ের মাঝে এক সবুজ ঘন বনে বাস করত এক শিকারী, তার নাম ছিল বার্ক।
 বার্কের বৌ মারা গেছে বহুদিন, শুধু তার ছোট্ট ছেলে এমিলকে নিয়েই তার জগত। বার্ক সারাদিন ধরে বনে বনে ঘুরে পশু পাখি শিকার করে, তাতেই কোনমতে বাপ বেটার চলে যায়।
 ছোট্ট এমিল তার বাবার পায়ে পায়ে ঘোরে, কিন্তু পশু পাখি শিকারে তার মন লাগে না! নীল পাহাড় আর সবুজ বনের মাঝে ঘুরে বেড়াতেই তার যত আনন্দ।
 এইভাবেই বেশ তাদের দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু কপাল খারাপ, হঠাৎ একদিন মাত্র দুদিনের জ্বরে বার্ক মারা গেল। এমিলের বয়স তখন মোটে ষোল কি সতের। 
 সম্বলের মধ্যে শুধু একখানা কুঁড়ে ঘর আর বাবার পাখি ধরার ফাঁদটা। 
 মনের দুঃখে শেষমেষ বাবার ফাঁদটা নিয়েই বেচারা বেরিয়ে পড়ল। 
 গভীর বনের মাঝে আপনমনে এগিয়ে চলতে লাগল এমিল। কোথায় গেলে পাখি ধরা যাবে, কোথায় ফাঁদ পাতা যেতে পারে, কিচ্ছুটি তার জানা নেই।
সারাদিন হেঁটে হেঁটে শেষমেষ একসময় ক্লান্ত হয়ে এক বিরাট ওক গাছের মাথায় ফাঁদ পেতে গাছের নীচেই চুপ করে বসে পড়ল এমিল।
 আর তারপর কখন যে তার দুচোখ ঘুমে এলিয়ে এল কে জানে! 
 বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একটা ডানা ঝাপটানোর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার! সাত তাড়াতাড়ি গাছের উপর উঠে বেচারা দেখে, ফাঁদে ধরা পড়েছে একটা কুচকুচে কালো কাক!
বিরক্তিতে এমিলের ভুরু কুঁচকে যায়, সারাদিনের খাটনির পর শেষমেষ ধরা পড়ল কিনা একটা কাক!
কী হবে এখন এই কাক দিয়ে?
 এমন সময় হঠাৎ কাকটা মানুষের গলায় বলে উঠল “আমায় ছেড়ে দাও এমিল, আমায় তো কেউ কিনবে না। বরং আমায় ছেড়ে দিলে একটু পরেই তোমার ফাঁদে ভারি সুন্দর একটি পাখি ধরা পড়বে। সেই পাখি খোদ মহারাজের কাছে বিক্রি করে তুমি অনেক অনেক টাকা বকশিস পাবে।“
 ভয়ে আঁতকে উঠে এমিল বলে ওঠে “কে তুমি? আমার নাম জান, পাখি হয়ে মানুষের স্বরে কথা বলে উঠছ! তুমি কি কোন ছদ্মবেশী ডাইনী , যাদুকর?“
 কাকটি মিষ্টি স্বরে বলে ওঠে “আমার নাম এলিফ, আমি কে তা তুমি যথা সময়েই জানতে পারবে। কিন্তু আগে এখন আমাকে মুক্তি দাও। বিশ্বাস রাখ, আমার কথা সত্যি হবে। একটু পরেই তোমার ফাঁদে ধরা পড়বে বহু দূর দেশের ভারি সুন্দর একটি পাখি। মিলিয়ে নিও আমার কথা।“
 এমিল ভয়ে ভয়ে কাকটিকে ফাঁদ থেকে ছেড়ে দিয়ে গাছের নীচে এসে আবার বসে পড়ল। সন্ধে হয় কি না হয়, এমন সময় আবার ফাঁদের সুতোয় টান পড়লো। এমিল তড়িঘড়ি গাছে উঠে দেখল এবার ফাঁদে আটকা পড়েছে  অপূর্ব সুন্দর একটি ময়ূর !
তার গায়ে যেন রামধনুর সাতটা রঙই বড় যত্নে আঁকা!
এমিল তো মহাখুশি, এত সুন্দর পাখি ফাঁদে ধরা পড়া কি আর চাট্টিখানি কথা! কাক যা বলেছিল তা সত্যি তো অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে!
 এমিল পাখি নিয়ে আনন্দে নাচতে নাচতে চলল রাজবাড়ী।
 দেশের নতুন রাজা তখন হয়েছেন যুবরাজ বেসিম, তারও অল্প বয়স। মেরেকেটে বাইশ কী তেইশ।
 রাজকার্য তারও বিশেষ ভাল লাগে না, পুরোন মন্ত্রী আর সভাসদদের হাতে রাজ্যের ভার ছেড়ে দিয়ে আপন খেয়ালে তিনি সময় কাটান। 
 এমিলের হাতে এত সুন্দর পাখিটি দেখে রাজা বেসিম তো ভীষণ খুশি। সাথে সাথে নগদ দশ হাজার টাকা দিয়ে তিনি পাখিটা কিনে নিলেন এমিলের হাত থেকে।
 এমিলের টাকা পয়সার সমস্ত অভাব এক্কেবারে মিটে গেল।
 কিন্তু রাজার বুড়ো মন্ত্রী বুলুত কিন্তু এত ভাল মানুষ ছিলেন না, তার মনে মনে শুধু প্যাঁচ। অন্য কারোর ভাল সে দুচোখে দেখতে পারত না। একটা পাখির জন্য এক সামান্য ব্যাধের ছেলেকে এতগুলো টাকা পুরষ্কার দেওয়া তার মোটেই ভাল লাগল না।
কিন্তু রাজার মুখের উপর কিছু বলতে না পেরে সে আপনমনে গজগজ করতে লাগল। 
 এইদিকে রাজামশাই তো পাখি নিয়ে ভারি খুশি, তিনি এরপর একদিন সোনার দাঁড়ে পাখিকে বসিয়ে এনে রাখলেন তার রাজসভায়।
 যে দেখে সেই ধন্য ধন্য করে ওঠে আর বলে “এমন পাখি আর কোনদিনও দেখিনি।“
 শুনে হিংসায় বুড়ো মন্ত্রীর গা জ্বলে যায়। 
 তারপর একদিন এক ফন্দী এঁটে বুড়ো বুলুত এসে রাজাকে বললেন “মহারাজ পাখি তো অপূর্ব তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সোনার দাঁড়ে যে এই পাখি এক্কেবারে মানায় না।“
 বেসিম চিন্তিত হয়ে বলে ওঠে “তাহলে উপায় ?”
 বুড়ো ফোকলা মুখে শয়তানি হাসি হেসে বলে ওঠে “হাতির দাঁতের দাঁড় তৈরী করান মহারাজ, তবেই এই পাখী মানাবে।“
 রাজা আরো চিন্তিত হয়ে বলে উঠলেন “কিন্তু অত গজদন্ত পাব কোথায়?”
- কেন যে ছোকরা পাখী এনেছে, তাকেই হুকুম করুন না।“
- সে তো শুধু বনে পশু পাখী ধরে বেড়ায়, সে কীভাবে গজদন্ত খুঁজে পাবে?
 শয়তান বুড়ো হেসে বলে ওঠে “ওরা জঙ্গলের সব চেনে, দেখুন না কীভাবে আপনাকে এই পাখি খুঁজে এনে দিল। দেখবেন ঐ ঠিক গজদন্তও খুঁজে বার করে আনবে। চিন্তা নেই আমিই তাকে খবর দিচ্ছি“
 বুড়ো পরের দিনই এমিলকে ডেকে আনলেন, বললেন “গজদন্ত চাই, রাজার হুকুম। পাখির দাঁড় বানাতে লাগবে।“
 এমিল শুকনো মুখে বলে উঠল “কিন্তু আমি তা কোথায় খুঁজে পাব?”
 বুড়ো বাঁকা সুরে বলে ওঠে “ওসব আমি জানি না, যাও যেখান থেকে পারো খুঁজে এনে দাও। আনতে পারলে পুরষ্কার পাবে। আর না পারলে গর্দান যাবে। এখন যাও তো বাপু, তাড়াতাড়ি খুঁজতে বেরিয়ে পড় গিয়ে।“
 এমিল মলিন মুখে বেরিয়ে পড়ল। 
 কোথায় সে খুঁজে পাবে গজদন্ত, কিছুই তার জানা নেই। গভীর বনের মাঝে কোথায় আর বেচারা খুঁজে মরবে?
 একটা সময় ক্লান্ত হয়ে এক গাছের তলায় সে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। 
 এমন সময় হঠাৎ কে যেন মধুর সুরে তাকে ডেকে উঠল “এমিল, কি হয়েছে ? কী এত ভাবছ ?”
 এমিল চমকে উঠে দেখে সেই কাকটা, এলিফ আবার তার সামনে এসে বসে আছে।
 এমিল ভাঙা স্বরে বলে ওঠে “রাজার হুকুম, পাখির জন্য দাঁড় বানাতে গজদন্ত চাই। না হলে গর্দান যাবে। এই এত বড় অরণ্যে আমি এখন কোথায় গজদন্ত খুঁজি বল তো ?”
 পাখি সাথে সাথে বলে উঠল “ওহ এই ব্যাপার, আমি ভাবি কী না কী ? যাও রাজাকে বলো গে একশো গাধার পিঠে একশো কলসী মদ এনে দিতে আগে।“
-অতো মদ কে খাবে ? 
- যা বলছি কর না বাপু, তোমারই গর্দান বাঁচানোর চেষ্টা করছি। আগে যা বললাম তা করো, তারপর দেখবেখন কারা খায় অত মদ!
 এমিল এসে রাজা বেসিমকে বলল “মহারাজ গজদন্ত আনতে গেলে একশো গাধার পিঠে আগে একশো কলসী মদ চাই।“
 রাজা সাথে সাথে হুকুম দিয়ে দিলেন।
 একশো গাধার পিঠে একশো কলসী মদ চাপিয়ে এমিল চলল বনের মাঝে সেই গাছের ধারে।
 কাক বসেছিল গাছের ডালে, বলে উঠল “এনেছ, বেশ বেশ! এখন সোজা চলে যাও দিকি বনের ভেতর পানে। রসো আমি আগে আগে উড়ে যাই, তুমি আমার পিছন পিছন তোমার গাধার দল নিয়ে আসো। দেখবে বনের ঠিক মাঝে সবুজ গাছ গাছালির মাঝে লুকিয়ে আছে একটা বিশাল পুকুর। ওই পুকুরের জলে এই একশো কলসী মদ ঢেলে দাও। তারপর গাছের ডালে উঠে বসে থাক। দেখ কী হয়।“ 
 কাকের পেছন পেছন উড়ে এমিল এসে পৌছাল এক গভীর বনের মাঝে। বিশাল বিশাল সবুজ গাছ আর ঘন এক মানুষ ঘাসের মাঝে সেখানে সূর্যের আলোও যেন সহজে ঢুকতে নারাজ।
 ওমা, এই গভীর বনের মাঝে যে এত সুন্দর একটা পুকুর লুকিয়ে আছে তা তো বাইরে থেকে দেখে বোঝাই যায় না!
 কাকের কথামত এবার ওই পুকুরের জলে একশো কলসী মদ মিশিয়ে দিয়ে এমিল চুপিচুপি উঠে পড়ল এক গাছের ডালে, আর কাক এসে বসল তার মাথার উপরের আরেকটা ডালে। 
 বেলা এগিয়ে এল, একসময় পশ্চিম আকাশে লাল আবীর ছড়িয়ে দিয়ে সূয্যিও অস্ত গেল। রাতের কালো অন্ধকারে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ল গভীর বনের মাঝে। 
 চারদিকে শুধু নিকষ অন্ধকার, আর তার মাঝে ভেসে আসে কত শত হিংস্র জন্তুর হুংকার ! বনের ছেলে এমিলেরও যেন এবার সত্যি সত্যি গা ছমছম করে উঠল। 
 এমন সময় হঠাৎ তার চোখে পড়ল এক পাল হাতি দল বেঁধে আসছে পুকুর ঘাটে জল খেতে, পুকুর পারে এসে এবার শুরু হল তাদের মাতামাতি, দাপাদাপি, হাঁকডাক।
 অন্ধকারে কিছুই তেমন এমিলের চোখে পড়েনা, কিন্তু গোলমালের শব্দে সব বোঝা যায়।
 কিছু সময় পর হঠাৎ সব চুপ।
 কাক এবার ফিসফিস করে বলে উঠল “এমিল, এটাই সুযোগ, শিগগীর পুকুরে অন্য প্রান্তে চলে যাও। ঐ পারেই হাতিদের মৃত্যু ভূমি। যত হাতি আছে তারা সবাই মৃত্যুর আগে ঐ প্রান্তে তাদের মরণের অপেক্ষা করে। তাড়াতাড়ি গিয়ে মৃত হাতিদের ভীড় দেখে যে কটা গজদন্ত প্রয়োজন নিয়ে এস। কিন্তু সাবধান, ভুলেও দেরী করোনা, হাতিরা একবার ঘুম ভেঙে উঠে পড়লে আর প্রাণে বাঁচবে না। “
 আর দেরী! এমিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছুটে গেল পুকুরের অন্য প্রান্তে। সেখানে যেন হাতির কংকালের পাহাড়। পৃথিবীর যত হাতি বুঝি এখানেই এসে মরে।
 এমিল দেখে শুনে এক প্রকাণ্ড গজদন্ত তুলে নিল কাঁধে ! বাপ রে, কী বিষম ভারী সেই দাঁত। কোনমতে পুকুরের আরেক প্রান্তে টেনে আনতেই বেচারার যেন দম বেরিয়ে গেল।
 তারপর সেই দাঁত গাধার পিঠে চাপিয়ে সে ফিরল রাজধানীতে। 
 রাজা বেসিম তো সেই গজদন্ত পেয়ে ভারী খুশি, এবার নগদ এক লক্ষ টাকা পুরষ্কার দিলেন তিনি এমিলকে আর শুধু তাই নয় বন্ধুর মত তাকে পাশে বসিয়ে মন খুলে গল্প করলেন রাজামশাই। এত দিন পর কারোর সাথে মন খুলে কথা বলতে পেরে এমিলও যেন শান্তির নিশ্বাস ফেলল।
 মনের আনন্দে প্রাসাদ থেকে ফিরে এলো সে। 
 গজদন্ত দিয়ে এবার তৈরী হল পাখির দাঁড়, সেই দাঁড়ে ময়ূর বসল। যে এসে দেখে সেই বলল “এবার মানিয়েছে বটে”
 দেখে তো মন্ত্রী বুলুতের মন আরো হিংসেয় জ্বলে গেল, কোথাকার এক জংলি ব্যাধের ছেলে তার প্রশংসা কত! রাজামশাইয়েরও যেমন বুদ্ধি! আর লোক পেল না বেছে বেছে বন্ধু বানালো ওই হাঘরে ছেলেটাকে!
 মুখে সে আর কিছু বলল না বটে, শুধু মনে মনে  আরো ভয়ংকর কোন দুষ্টু বুদ্ধি ভাঁজতে লাগল।

Continue...........

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.