Biggani - Rabindranath thakur bangla choto golpo

বিজ্ঞানী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


দাদামশায়, নীলমণিবাবুকে তোমার এত কেন ভালো লাগে আমি তো বুঝতে পারি নে।
 
এই প্রশ্নটা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত প্রশ্ন, এর ঠিক উত্তর ক'জন লোকে দিতে পারে।

 
তোমার হেঁয়ালি রাখো। অমন এলোমেলো আলুথালু অগোছালো লোককে মেয়েরা দেখতে পারে না।
 
ওটা তো হল সার্টিফিকেট, অর্থাৎ লোকটা খাঁটি পুরুষমানুষ।
 
জান না তুমি, উনি কথায় কথায় কী রকম হুলুস্থূল বাধিয়ে তোলেন। হাতের কাছে যেটা আছে সেটা ওঁর হাতেই ঠেকে না। সেটা উনি খুঁজে বেড়ান পাড়ায় পাড়ায়।
 
ভক্তি হচ্ছে তো লোকটার উপরে।
 
কেন শুনি।
 
হাতের কাছের জিনিসটাই যে সবচেয়ে দূরের সে ক'জন লোক জানে, অথচ নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে।
 
একটা দৃষ্টান্ত দেখাও দেখি।
 
যেমন তুমি।
 
আমাকে তুমি খুঁজে পাও নি বুঝি?
 
খুঁজে পেলে যে রস মারা যেত, যত খুঁজছি তত অবাক হচ্ছি।
 
আবার তোমার হেঁয়ালি।
 
উপায় নেই। দিদি, আমার কাছে আজও তুমি সহজ নও, নিত্যি নূতন।
 
কুসমি দাদামশায়ের গলা জড়িয়ে বললে, দাদামশায় এটা কিন্তু শোনাচ্ছে ভালো। কিন্তু, ও কথা থাক্‌। নীলুবাবুর বাড়িতে কাল কী রকম হুলুস্থূল বেধেছিল সে খবরটা বিধুমামার কাছে শোনো-না।
 
কী গো মামা, কী হয়েছিল শুনি।
 
অদ্ভুত-- বিধুমামা বললেন, পাড়ায় রব উঠল নীলুবাবুর কলমটা পাওয়া যাচ্ছে না; খোঁজ পড়ে গেল মশারির চালে পর্যন্ত। ডেকে পাঠালে পাড়ার মাধুবাবুকে।
 
বললে, ওহে মাধু, আমার কলমটা?
 
মাধুবাবু বললেন, জানলে খবর দিতুম।
 
ধোবাকে ডাক পড়ল, ডাক পড়ল হারু নাপিতকে। বাড়িসুদ্ধ সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে তখন তার ভাগ্নে এসে বললে, কলম যে তোমার কানেই আছে গোঁজা।
 
যখন কোনো সন্দেহ রইল না তখন ভাগ্নের গালে এক চড় মেরে বললে, বোকা কোথাকার, যে কলমটা পাওয়া যাচ্ছে না সেটাই খুঁজছি।

 
রান্নাঘর থেকে স্ত্রী এল বেরিয়ে; বললে, বাড়ি মাথায় করেছ যে।
 
নীলু বললে, যে কলমটা চাই ঠিক সেই কলমটা খুঁজে পাচ্ছি না।
 
বউদি বললে, যেটা পেয়েছ সেই দিয়েই কাজ চালিয়ে নেও, যেটা পাও নি সেটা কোথাও পাবে না।
 
নীলু বললে, অন্তত সেটা পাওয়া যেতে পারে কুণ্ডুদের দোকানে।
 
বউদি বললে, না গো, দোকানে সে মাল মেলে না।
 
নীলু বললে, তা হলে সেটা চুরি গিয়েছে।
 
তোমার সব জিনিসই তো চুরি গিয়েছে, যখন চোখে পাও না দেখতে। এখন চুপচাপ ক'রে এই কলম নিয়েই লেখো, আমাকেও কাজ করতে দাও। পাড়াসুদ্ধ অস্থির করে তুলেছ।
 
সামান্য একটা কলম পাব না কেন শুনি।
 
বিনি পয়সায় মেলে না ব'লে।
 
দেব টাকা -- ওরে ভুতো।
 
আজ্ঞে--
 
টাকার থলিটা যে খুঁজে পাচ্ছি না।
 
ভুতো বললে, সেটা যে ছিল আপনার জামার পকেটে।
 
তাই নাকি।
 
পকেট খুঁজে দেখলে থলি আছে, থলিতে টাকা নেই। টাকা কোথায় গেল।
 
খুঁজতে বেরোল টাকা। ডেকে পাঠালে ধোবাকে।
 
আমার পকেটের থলি থেকে টাকা গেল কোথায়।
 
ধোবা বললে, আমি কী জানি। ও জামা আমি কাচি নি।
 
ডাকল ওসমান দর্জিকে।
 
আমার থলি থেকে টাকা গেল কোথায়।
 
ওসমান রেগে উঠে বললে, আছে আপনার লোহার সিন্দুকে।
 
জামাইবাড়ি থেকে স্ত্রী ফিরে এসে বললে, হয়েছে কী।
 
নীলমণি বললে, বাড়িতে ডাকাত পুষেছি। পকেট থেকে টাকা নিয়ে গেছে।
 
স্ত্রী বললে, হায় রে কপাল-- সেদিন যে বাড়িওয়ালাকে বাড়িভাড়া শোধ করে দিলে ৩৫৲ টাকা।

 
তাই নাকি। বাড়িওয়ালা যে বাড়ি ছাড়বার জন্য আমাকে নোটিশ পাঠিয়েছিল।
 
তুমি ভাড়া শোধ করে দিয়েছিলে তার পরেই।
 
সে কী কথা। আমি যে বাদুড়বাগানে নিমচাঁদ হালদারের কাছে গিয়ে তার বাড়ি ভাড়া নিয়েছি।
 
স্ত্রী বললে, বাদুড়বাগান, সে আবার কোন্‌ চুলোয়।
 
নীলমণি বললে, রোসো, ভেবে দেখি। সে যে কোন্‌ গলিতে কোন্‌ নম্বরে তা তো মনে পড়ছে না। কিন্তু লোকটির সঙ্গে লেখাপড়া হয়ে গেছে--দেড় বছরের জন্য ভাড়া নিতে হবে।
 
স্ত্রী বললে, বেশ করেছ, এখন দুটো বাড়ির ভাড়া সামলাবে কে।
 
নীলমণি বললে, সেটা তো ভাবনার কথা নয়। আমি ভাবছি, কোন্‌ নম্বর, কোন্‌ গলি। আমার নোটবুকে বাদুড়বাগানের বাসা লেখা আছে। কিন্তু, মনে পড়ছে না, গলিটার নম্বর লেখা আছে কি না।
 
তা, তোমার নোটবইটা বের করো-না।
 
মুশকিল হয়েছে যে, তিন দিন ধরে নোটবইটা খুঁজে পাচ্ছি না।
 
ভাগ্নে বললে, মামা, মনে নেই? সেটা যে তুমি দিদিকে দিয়েছিলে স্কুলের কপি লিখতে।
 
তোর দিদি কোথায় গেল।
 
তিনি তো গেছেন এলাহাবাদে মেসোমশায়ের বাড়িতে।
 
মুশকিলে ফেললি দেখছি। এখন কোথায় খুঁজে পাই, কোন্‌ গলি, কোন্‌ নম্বর।
 
এমন সময়ে এসে পড়ল নিমচাঁদ হালদারের কেরানি। সে বললে, বাদুড়বাগানের বাড়ির ভাড়া চাইতে এসেছি।
 
কোন্‌ বাড়ি।
 
সেই যে ১৩ নম্বর শিবু সমাদ্দারের গলি।
 
বাঁচা গেল, বাঁচা গেল। শুনছ, গিন্নি? ১৩ নম্বর শিবু সমাদ্দারের গলি। আর ভাবনা নেই।
 
শুনে আমার মাথামুণ্ডু হবে কী।
 
একটা ঠিকানা পাওয়া গেল।
 
সে তো পাওয়া গেল। এখন দুটো বাড়ির ভাড়া সামলাবে কেমন করে।
 
সে কথা পরে হবে। কিন্তু, বাড়ির নম্বর ১৩, গলির নাম শিবু সমাদ্দারের গলি।

 
কেরানির হাত ধরে বললে, ভায়া, বাঁচালে আমাকে। তোমার নাম কী বলো, আমি নোটবইয়ে লিখে রাখি।
 
পকেট চাপড়ে বললে, ঐ যা। নোটবই আছে এলাহাবাদে। মুখস্থ করে রাখব-- ১৩ নম্বর, শিবু সমাদ্দারের গলি।
 
কুসমি বললে, এই কলম হারানো ব্যাপারটা তো সামান্য কথা। যেদিন ওঁর একপাটি চটিজুতো পাওয়া যাচ্ছিল না, সেদিন নীলমণিবাবুর ঘরে কী ধুন্দুমার বেধে গিয়েছিল। ওঁর স্ত্রী পণ করলেন, তিনি বাপের বাড়ি চলে যাবেন। চাকর-বাকররা একজোট হয়ে বললে, যদি একপাটি চটিজুতো নিয়ে তাদের সন্দেহ করা হয় তবে তারা কাজে ইস্তফা দেবে-- তার উপরে সে চটিতে তিন তালি দেওয়া।
 
আমি বললুম, খবরটা আমারও কানে এসেছিল; দেখলেম ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেলুম নীলুর বাড়িতে। বললুম, ভায়া, তোমার চটি হারিয়েছে?
 
সে বললে, দাদা, হারায় নি, চুরি গিয়েছে, আমি তার প্রমাণ দিতে পারি।
 
প্রমাণের কথা তুলতেই আমি ভয় পেয়ে গেলুম। লোকটা বৈজ্ঞানিক; একটা দুটো তিনটে ক'রে যখন প্রমাণ বের করতে থাকবে আমার নাওয়া-খাওয়া যাবে ঘুচে। আমাকে বলতে হল, নিশ্চয় চুরি গিয়েছে। কিন্তু এমন আশ্চর্য চোরের আড্ডা কোথায় যে একপাটি চটি চুরি করে বেড়ায়, আমার জানতে ইচ্ছে করে।
 
নীলু বললে, ওইটেই হচ্ছে তর্কের বিষয়। এর থেকে প্রমাণ হয় যে, চামড়ার বাজার চড়ে গিয়েছে।

 
আমি দেখলুম, এর উপরে আর কথা চলবে না। বললুম, নীলুভাই, তুমি আসল কথাটি ধরতে পেরেছ। আজকালকার দিনে সবই বাজার নিয়ে। তাই আমি দেখেছি, মল্লিকদের দেউড়িতে পাঁচ-সাত দিন অন্তর মুচি আসে দরোয়ানজির নাগরা জুতোয় সুকতলা বসাবার ভান ক'রে। তার দৃষ্টি রাস্তার লোকদের পায়ের দিকে।
 
তখনকার মতো তাকে আমি ঠাণ্ডা করেছিলুম। তার পরে সেই চটি বেরোল বিছানার নীচে থেকে। নীলুর পেয়ারের কুকুর সেটা নিয়ে আনন্দে ছেঁড়াছেঁড়ি করেছে। নীলুর সবচেয়ে দুঃখ হল এই চটির সন্ধান পেয়ে, তার প্রমাণ গেল মারা।
 
কুসমি বললে, আচ্ছা, দাদামশায়, মানুষ এতবড়ো বোকা হয় কী ক'রে।
 
আমি বললুম, অমন কথা বোলো না দিদি, অঙ্কশাস্ত্রে ও পণ্ডিত। অঙ্ক ক'ষে ক'ষে ওর বুদ্ধি এত সূক্ষ্ম হয়েছে যে, সাধারণ লোকের চোখে পড়ে না।
 
কুসমি নাক তুলে বললে, ওঁর অঙ্ক নিয়ে কী করছেন উনি।
 
আমি বললুম, আবিষ্কার। চটি কেন হারায় সেটা উনি সব সময়ে খুঁজে পান না, কিন্তু চাঁদের গ্রহণ লাগায় সিকি সেকেণ্ড দেরি কেন হয়, এ তাঁর অঙ্কের ডগায় ধরা পড়বেই। আজকাল তিনি প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন যে, জগতে গ্রহ তারা কোনো জিনিসই ঘুরছে না, তারা কেবলই লাফাচ্ছে। এ জগতে কোটি কোটি উচ্চিংড়ে ছাড়া পেয়েছে। এর অকাট্য প্রমাণ রয়েছে ওর খাতায়। আমি আর কথা কই নে, পাছে সেগুলো বের করতে থাকেন।
 
কুসমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললে, ওঁর কি সবই অনাসৃষ্টি। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে উচ্চিংড়ের লাফ মেপে মেপে অঙ্ক কষছেন! এ না হলে ওঁর এমন দশা হবে কেন।
 
আমি বললুম, ওর ঘরকন্না ঘুরতে ঘুরতে চলবে না, তিড়িং-বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে চলবে।
 
কুসমি বললে, এতক্ষণে বুঝলুম, এ লোকটার কলমই বা হারায় কেন, একপাটি চটিই বা পাওয়া যায় না কেন, আর তুমিই বা কেন ওঁকে এত ভালোবাস। যত পাগলের উপরে তোমার ভালোবাসা, আর তারাই তোমার চার দিকে এসে জোটে।
 
দেখো দিদি, সবশেষে তোমাকে একটা কথা বলে রাখি। তুমি ভাবছ, নীলু লক্ষ্ণীছাড়াকে নিয়ে তোমার বউদি রেগেই আছেন। গোপনে তোমাকে জানাচ্ছি-- একেবারে তার উল্টো। ওর এই এলোমেলো আলুথালু ভাব দেখেই তিনি মুগ্ধ। আমারও সেই দশা।
..............................................................................................
 
পাঁচটা না বাজতেই ভুলুরাম শর্মা সে
টেরিটিবাজারে গেল মনিবের ফর্‌মাশে।
মরেছে অতুল মামা, আজি তারি শ্রাদ্ধের
জোগাড় করতে হবে নানাবিধ খাদ্যের।
বাবু বলে, ভুলো না হে, আরো চাই দর্‌মা।
ভোলা কি সহজ কথা, বলে ভুলু শর্মা।
কাঁক্‌রোল কিনে বসে কাঁচকলা কিনতে।
শাঁকআলু কচু কিনা পারে না সে চিনতে।
বকুনি খেয়েছে যেই মাছওলা মিন্‌সের,
তাড়াতাড়ি কিনে বসে কামরাঙা তিন সের।
বাবু বলে, কামরাঙা এতগুলো হবে কী।
ভুলু বলে, কানে আমি শুনি নাই তবে কি।
দেখলেম কিনছে যে ও পাড়ার সরকার,
বুঝলেম নিশ্চয় আছে এর দরকার।
কানে গুঁজে নিয়ে তার হিসাবের লেখনী
বাবু বলে, ফিরে দিয়ে এসো তুমি এখনি।
মনিবের হুকুমটা শুনল সে হাঁ ক'রে,
ফিরে দিতে চ'লে গেল কিছু দেরি না ক'রে।
বললে সে, দোকানিকে যা করেছি জব্দ--
ফলগুলো ফিরে নিতে করে নি টুঁ শব্দ।
বাবু কয় 'টাকা কই' টান দিয়ে তামাকে।
ভুলু বলে, সে কথাটা বল নি তো আমাকে।
এসেছি উজাড় ক'রে বাজারের ঝুড়িটা--
দোকানির মাসি ছিল, হেসে খুন বুড়িটা।

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.