অনুজের হস্ত ধরিয়া হাসান নিজ শয্যার উপরে বসাইয়া মুখে বারবার চুম্বন দিয়া বলিতে লাগিলেন, ভাই, আমি যে কষ্ট পাইতেছি তাহা মুখে বলিবার শক্তি নাই। পূর্ব আঘাত, পূর্ব পীড়া এই উপস্থিত যন্ত্রণায় সকলি ভুলিয়া গিয়াছি। দেখত, আমার মুখের বর্ণ কি পরিবর্তিত হইয়াছে?
ভ্রাতার মুখপানে দৃষ্টিপাত করিয়া হোসেন কাঁদিতে লাগিলেন। আর আর সকলে বলিতে লাগিল, আহা ! জ্যোতির্ময় চন্দ্রবদনে বিষাদনীলিমার রেখা পড়িয়াছে।
এই কথা শুনিয়া হাসান অনুজকে বলিলেন, ভাই, বৃথা কাঁদিয়া লাভ কী? আমার আর বেশি বিলম্ব নাই; চিরবিদায়ের সময় অতি নিকট। মাতামহ যাহা বলিয়াছিলেন, সকলি প্রত্যক্ষ করিতেছি। ভাই, মাতামহ সশরীরে ঈশ্বরের আদেশে একবার ঈশ্বরের স্থানে নীত হইয়াছিলেন। সেখানে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে অতি রমণীয় দুইটি ঘর সুসজ্জিত দেখিলেন। একটি সবুজ বর্ণ, আর একটি লোহিত বর্ণ। কাহার ঘর, প্রহরীকে এই কথা জিজ্ঞাসা করাতে প্রহরী উত্তর করিল, আপনার অন্তরের নিধি হৃদয়ের ধন এবং নয়নের পুত্তলি হাসান-হোসেনের জন্য দুইটি ঘর প্রতুত হইয়াছে। ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের কারণ জিজ্ঞাসা করাতে প্রহরী কঁপিয়া নতশির হইল, কোনো উত্তর করিল না। জিব্রাইল সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন। তিনিই মাতামহকে বলিলেন, হায় মুহম্মদ! দ্বারবান কারণ প্রকাশে লজ্জিত হইতেছে, আমি আপনি যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহাই বলিতে আজ্ঞাপ্রাপ্ত হইয়াছি। নিদারুণ গুপ্ত কথা হইলেও আজ আমি আপনার নিকটে ব্যক্ত করিব। ঐ দুইটি ঘর ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের হইবার কারণ কী উহার সবিশেষ বৃত্তান্ত বলিতেছি শ্রবণ করুন। সবুজ বর্ণ গৃহ আপনার জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র হাসানের জন্য; লোহিতবর্ণ কনিষ্ঠ হোসেনের জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। আপনার অভাবে একদল পিশাচ শত্রুতা করিয়া হাসানকে বিষ পান করাইবে এবং মৃত্যুসময়ে হাসানের মুখ সবুজ বর্ণ হইবে। তন্নিমিত্ত ঐ গৃহটি সবুজ বর্ণ। ঐ শত্রুগণ অস্ত্রদ্বারা আপনার কনিষ্ঠ দৌহিত্র হোসেনের মস্তকছেদন করিবে। ঐ রক্তমাখা মুখের চিহ্নই লোহিতবর্ণের কারণ। মাতামহের বাক্য আজ সফল হইল । আমার মুখের বর্ণ যখন বিবর্ণ হইয়াছে, তখন পরমায়ুও আজ শেষ হইয়াছে। মাতামহের বাক্য অলঙ্ঘনীয় ভাই, ঈশ্বরের কার্যও অখণ্ডনীয়।
সবিষাদে এবং সরোষে হোসেন বলিতে লাগিলেন, আমি আপনার চির আজ্ঞাবহ দাস, বিশেষ স্নেহের পাত্র এবং চিরআশীর্বাদের আকাক্ষী, মিনতি করিয়া বলিতেছি, বলুন তো, আপনাকে এ বিষ কে দিয়াছে?
ভাই! তুমি কী জন্য বিষদাতার নাম জিজ্ঞাসা করিতেছ? তুমি কি তাহার প্রতিশোধ নিবে?
হোসেন শয্যা হইতে উঠিয়া অতিশয় রোষভাবে দুঃখিত স্বরে বলিতে লাগিলেন, আমার প্রাণের পূজনীয় ভ্রাতাকে- এক মাতার উদরে যে ভ্রাতা অগ্রে জন্মিয়াছেন, সেই ভ্রাতাকে, আমি বাঁচিয়া থাকিতে যে নরাধম বিষ পান করাইয়াছে সে কি অমনিই বাঁচিয়া যাইবে? আমি কি এমনই দুর্বল, আমি কি এমনই নিঃসাহসী, আমি কি এমনই ক্ষীণকায়, আমি কি এমনই কাপুরুষ, আমার হৃদয়ে কি রক্ত নাই, ভ্রাতৃস্নেহ নাই যে, ভ্রাতার প্রাণনাশক বিষম্প্রদায়কের প্রতিশোধ লইতে পারিব না? যে আজ আমার একটি বাহু ভগ্ন করিল, অমূল্যধন সহোদর রত্ন হইতে যেআজ আমাকে বঞ্চিত করিল, আমি কি তাহার কিছুই করিব না? যদি সে নরাধমের কোনো সন্ধান জানিয়া থাকেন, যদি তাহাকে চিনিয়া থাকেন, যদি অনুমানে কিছু অনুভব করিয়া থাকেন, এ আজ্ঞাবহ চিরকিঙ্করকে বলুন, আমি এখনই আপনার সম্মুখে তাহার প্রতিবিধান করিতেছি। সেই পাপাত্মা বিজনবনে, পর্বতগুহায়, অতল জলে, সপ্ততল মৃত্তিকা মধ্যে যেখানে হউক, হোসেনের হস্ত হইতে তাহার পরিত্রাণ নাই। হয় আমার প্রাণ তাহাকে দিব, নয় তাহার প্রাণ আমি লইব।
অনুজের হত ধরিয়া নিকটে বসাইয়া হাসান বলিতে লাগিলেন, ভাই, স্থির হও। আমি আমার বিষদাতাকে চিনি। সে আমার সহিত যেরূপ ব্যবহার করিল, আমি সমুদয়ই জানিতে পারিয়াছি। ঈশ্বরই তাহার বিচার করিবেন। আমার কেবল এইমাত্র আক্ষেপ যে, অকারণে আমাকে নির্যাতন করিল। আমার ন্যায় অনুগত স্নেহশীল বন্ধকে বধ করিয়া সে যে কী সুখ মনে করিল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। যে কারণেই হউক, যে লাভেই হউক, যে আশায়ই হউক, নিরপরাধে যে আমাকে। নির্যাতন করিয়া চিরবন্ধর প্রাণবধ করিল, দয়াময় পরমেশ্বর তাহার আশা কখনই পূর্ণ করিবেন না। দুঃখের বিষয় এই যে, সে আমাকে চিনিতে পারিল না। যাহা হউক, ভাই, তাহার নাম আমি কখনই মুখে আনিব না। তাহার প্রতি আমার রাগ হিংসাদ্বেষ কিছুই নাই। ঈশ্বরের নামে শপথ করিয়া বলিতেছি, আমার বিষদাতার মুক্তির জন্য ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিব। যে পর্যন্ত ঈশ্বরের নিকট হইতে তাহাকে মুক্ত করাইতে না পারি, সে পর্যন্ত স্বর্গের সোপানে পা রাখিব না। ভাই! ক্রমেই আমার বাকশক্তি রোধ হইতেছে। কত কথা মনে ছিল কিছুই বলিতে পারিলাম না। চতুর্দিক যেন অন্ধকারময় দেখিতেছি।
আবুল কাসেমের হত ধরিয়া হোসেনের হতে সমর্পণ করিয়া স্নেহা চিত্তে হাসান কাতরস্বরে পুনরায় কহিতে লাগিলেন, ভাই, ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ মানিয়া আজ আমি তোমার হতে কাসেমকে দিলাম। কাসেমের বিবাহ দেখিতে বড় সাধ ছিল, পাত্রীও স্থির করিয়াছিলাম, সময় পাইলাম না। হোসেনের হত ধরিয়া আবার কহিলেন, ভাই ঈশ্বরের দোহাই, আমার অনুরোধ, তোমার কন্যা সখিনার সহিত কাসেমের বিবাহ দিও। আর ভাই আমার বিষদাতার যদি সন্ধান পাও কিংবা কোনো সূত্রে যদি ধরা পড়ে, তবে তাহাকে কিছু বলিও না। ঈশ্বরের দোহাই, তাহাকে ক্ষমা করিও। যন্ত্রণাকুল ইমাম ব্যাকলভাবে অনুজকে এই পর্যন্ত বলিয়া সস্নেহ বচনে কাসেমকে বলিলেন, কাসেম, বত্স আর্শীবাদ করি তুমি চিরজীবী হও। আর বাপ। এই কবচটি সর্বদা হতে বাঁধিয়া রাখিও। যদি কখনও বিপদগ্রস্ত হও সে বিপদ হইতে রক্ষা পাইবার উপায় যদি নিজ বুদ্ধিতে কিছুতেই স্থির করিতে না পার তবে এই কবচের অপর পৃষ্ঠে লক্ষ করিও; যাহা লেখা দেখিবে সেইরূপে কার্য করিবে। সাবধান তাহার অন্যথা করিও না।
কিয়ৎক্ষণ পর নিতন্ধ থাকিয়া উপর্যুপরি তিন চারিটি নিঃশ্বাস ফেলিয়া হোসেনকে সম্বোধনপূর্বক মুমূষু হাসান পুনরায় কহিলেন, ভাই, ক্ষণকালের জন্য তোমরা সকলে একবার বাহিরে যাও। কেবল জাএদা একাকিনী এখানে উপস্থিত থাকুন। জাএদার সহিত নির্জনে আমার একটি বিশেষ কথা আছে।
সকলেই আজ্ঞা পালন করিলেন। শয্যার নিকটে জাএদাকে ডাকিয়া হাসান চুপি চুপি বলিতে লাগিলেন, জাএদা, তোমার চক্ষ হইতে হাসান এখন বিদায় হইতেছে, আর্শীবাদ করি, সুখে থাক। তুমি যে কার্য করিলে সমতই আমি জানিতে পারিয়াছি। তোমাকে বড়ই বিশ্বাস করিতাম। বড়ই ভালোবাসিতাম, তাহার উপযুক্ত কার্যই তুমি করিয়াছ। ভালো, সুখে থাক, আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম। হোসেনকেও ক্ষমা করিতে বলিয়াছি; তাহাও তুমি স্বকর্ণে শ্রবণ করিয়াছ। ভিতরের নিগূঢ় কথা যদি আমি হোসেনকে বলিতাম, তাহা হইলে যে কী অনর্থ সংঘটিত হইত, তাহা তুমি বুঝিতেই পারিতেছ। যাহা হউক আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম। কিন্তু যিনি সর্বসাক্ষী, সর্বময়, সর্বক্ষমার অধিকারী, তিনি তোমাকে ক্ষমা করিবেন কিনা বলিতে পারি না; তথাপি তোমার মুক্তির জন্য সর্বপ্রযত্নে সেই মুক্তিদাতার নিকট পুনঃপুন প্রার্থনা করিব। যে পর্যন্ত তোমাকে মুক্ত করাইতে না পারিব সেই পর্যন্ত আমি স্বর্গের সোপানে পা রাখিব না।
জাএদা অধোমুখে অশু বিসর্জন করিলেন, একটিও কথা কহিলেন না। সময়োচিত সংকেতধ্বনি শ্রবণে হোসেনের সহিত আর আর সকলেই গৃহমধ্যে পুনঃপ্রবেশ করিলেন। হাসান একে একে সকলের নিকট বিদায় লইলেন। হাসনেবানু ও জয়নাবের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া নিজকৃত অপরাধের মার্জনা চাহিলেন। শেষে হোসেনকে কহিলেন, হোসেন, এসো ভাই, জন্মের মতোন তোমার সহিত আলিঙ্গন করি। এই বলিয়া অনুজের গলা ধরিয়া সাশুনয়নে আবার বলিতে লাগিলেন, ভাই সময় হইয়াছে, ঐ মাতামহ স্বর্গের দ্বারে দাঁড়াইয়া ডাকিতেছেন। চলিলাম। এই শেষ কথা বলিয়াই ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে দয়াময় ইমাম হাসান সর্বসমক্ষে প্রাণত্যাগ করিলেন। হাসনেবানু, জয়নাব, কাসেম ও আর সকলে হাসানের পদলুণ্ঠিত হইয়া মাথা ভাঙিয়া কাঁদিতে লাগিলেন, জাএদা কাঁদিয়াছিলেন কিনা, তাহা কেহ লক্ষ করেন নাই।
ভ্রাতার মুখপানে দৃষ্টিপাত করিয়া হোসেন কাঁদিতে লাগিলেন। আর আর সকলে বলিতে লাগিল, আহা ! জ্যোতির্ময় চন্দ্রবদনে বিষাদনীলিমার রেখা পড়িয়াছে।
এই কথা শুনিয়া হাসান অনুজকে বলিলেন, ভাই, বৃথা কাঁদিয়া লাভ কী? আমার আর বেশি বিলম্ব নাই; চিরবিদায়ের সময় অতি নিকট। মাতামহ যাহা বলিয়াছিলেন, সকলি প্রত্যক্ষ করিতেছি। ভাই, মাতামহ সশরীরে ঈশ্বরের আদেশে একবার ঈশ্বরের স্থানে নীত হইয়াছিলেন। সেখানে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে অতি রমণীয় দুইটি ঘর সুসজ্জিত দেখিলেন। একটি সবুজ বর্ণ, আর একটি লোহিত বর্ণ। কাহার ঘর, প্রহরীকে এই কথা জিজ্ঞাসা করাতে প্রহরী উত্তর করিল, আপনার অন্তরের নিধি হৃদয়ের ধন এবং নয়নের পুত্তলি হাসান-হোসেনের জন্য দুইটি ঘর প্রতুত হইয়াছে। ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের কারণ জিজ্ঞাসা করাতে প্রহরী কঁপিয়া নতশির হইল, কোনো উত্তর করিল না। জিব্রাইল সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন। তিনিই মাতামহকে বলিলেন, হায় মুহম্মদ! দ্বারবান কারণ প্রকাশে লজ্জিত হইতেছে, আমি আপনি যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহাই বলিতে আজ্ঞাপ্রাপ্ত হইয়াছি। নিদারুণ গুপ্ত কথা হইলেও আজ আমি আপনার নিকটে ব্যক্ত করিব। ঐ দুইটি ঘর ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের হইবার কারণ কী উহার সবিশেষ বৃত্তান্ত বলিতেছি শ্রবণ করুন। সবুজ বর্ণ গৃহ আপনার জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র হাসানের জন্য; লোহিতবর্ণ কনিষ্ঠ হোসেনের জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। আপনার অভাবে একদল পিশাচ শত্রুতা করিয়া হাসানকে বিষ পান করাইবে এবং মৃত্যুসময়ে হাসানের মুখ সবুজ বর্ণ হইবে। তন্নিমিত্ত ঐ গৃহটি সবুজ বর্ণ। ঐ শত্রুগণ অস্ত্রদ্বারা আপনার কনিষ্ঠ দৌহিত্র হোসেনের মস্তকছেদন করিবে। ঐ রক্তমাখা মুখের চিহ্নই লোহিতবর্ণের কারণ। মাতামহের বাক্য আজ সফল হইল । আমার মুখের বর্ণ যখন বিবর্ণ হইয়াছে, তখন পরমায়ুও আজ শেষ হইয়াছে। মাতামহের বাক্য অলঙ্ঘনীয় ভাই, ঈশ্বরের কার্যও অখণ্ডনীয়।
সবিষাদে এবং সরোষে হোসেন বলিতে লাগিলেন, আমি আপনার চির আজ্ঞাবহ দাস, বিশেষ স্নেহের পাত্র এবং চিরআশীর্বাদের আকাক্ষী, মিনতি করিয়া বলিতেছি, বলুন তো, আপনাকে এ বিষ কে দিয়াছে?
ভাই! তুমি কী জন্য বিষদাতার নাম জিজ্ঞাসা করিতেছ? তুমি কি তাহার প্রতিশোধ নিবে?
হোসেন শয্যা হইতে উঠিয়া অতিশয় রোষভাবে দুঃখিত স্বরে বলিতে লাগিলেন, আমার প্রাণের পূজনীয় ভ্রাতাকে- এক মাতার উদরে যে ভ্রাতা অগ্রে জন্মিয়াছেন, সেই ভ্রাতাকে, আমি বাঁচিয়া থাকিতে যে নরাধম বিষ পান করাইয়াছে সে কি অমনিই বাঁচিয়া যাইবে? আমি কি এমনই দুর্বল, আমি কি এমনই নিঃসাহসী, আমি কি এমনই ক্ষীণকায়, আমি কি এমনই কাপুরুষ, আমার হৃদয়ে কি রক্ত নাই, ভ্রাতৃস্নেহ নাই যে, ভ্রাতার প্রাণনাশক বিষম্প্রদায়কের প্রতিশোধ লইতে পারিব না? যে আজ আমার একটি বাহু ভগ্ন করিল, অমূল্যধন সহোদর রত্ন হইতে যেআজ আমাকে বঞ্চিত করিল, আমি কি তাহার কিছুই করিব না? যদি সে নরাধমের কোনো সন্ধান জানিয়া থাকেন, যদি তাহাকে চিনিয়া থাকেন, যদি অনুমানে কিছু অনুভব করিয়া থাকেন, এ আজ্ঞাবহ চিরকিঙ্করকে বলুন, আমি এখনই আপনার সম্মুখে তাহার প্রতিবিধান করিতেছি। সেই পাপাত্মা বিজনবনে, পর্বতগুহায়, অতল জলে, সপ্ততল মৃত্তিকা মধ্যে যেখানে হউক, হোসেনের হস্ত হইতে তাহার পরিত্রাণ নাই। হয় আমার প্রাণ তাহাকে দিব, নয় তাহার প্রাণ আমি লইব।
অনুজের হত ধরিয়া নিকটে বসাইয়া হাসান বলিতে লাগিলেন, ভাই, স্থির হও। আমি আমার বিষদাতাকে চিনি। সে আমার সহিত যেরূপ ব্যবহার করিল, আমি সমুদয়ই জানিতে পারিয়াছি। ঈশ্বরই তাহার বিচার করিবেন। আমার কেবল এইমাত্র আক্ষেপ যে, অকারণে আমাকে নির্যাতন করিল। আমার ন্যায় অনুগত স্নেহশীল বন্ধকে বধ করিয়া সে যে কী সুখ মনে করিল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। যে কারণেই হউক, যে লাভেই হউক, যে আশায়ই হউক, নিরপরাধে যে আমাকে। নির্যাতন করিয়া চিরবন্ধর প্রাণবধ করিল, দয়াময় পরমেশ্বর তাহার আশা কখনই পূর্ণ করিবেন না। দুঃখের বিষয় এই যে, সে আমাকে চিনিতে পারিল না। যাহা হউক, ভাই, তাহার নাম আমি কখনই মুখে আনিব না। তাহার প্রতি আমার রাগ হিংসাদ্বেষ কিছুই নাই। ঈশ্বরের নামে শপথ করিয়া বলিতেছি, আমার বিষদাতার মুক্তির জন্য ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিব। যে পর্যন্ত ঈশ্বরের নিকট হইতে তাহাকে মুক্ত করাইতে না পারি, সে পর্যন্ত স্বর্গের সোপানে পা রাখিব না। ভাই! ক্রমেই আমার বাকশক্তি রোধ হইতেছে। কত কথা মনে ছিল কিছুই বলিতে পারিলাম না। চতুর্দিক যেন অন্ধকারময় দেখিতেছি।
আবুল কাসেমের হত ধরিয়া হোসেনের হতে সমর্পণ করিয়া স্নেহা চিত্তে হাসান কাতরস্বরে পুনরায় কহিতে লাগিলেন, ভাই, ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ মানিয়া আজ আমি তোমার হতে কাসেমকে দিলাম। কাসেমের বিবাহ দেখিতে বড় সাধ ছিল, পাত্রীও স্থির করিয়াছিলাম, সময় পাইলাম না। হোসেনের হত ধরিয়া আবার কহিলেন, ভাই ঈশ্বরের দোহাই, আমার অনুরোধ, তোমার কন্যা সখিনার সহিত কাসেমের বিবাহ দিও। আর ভাই আমার বিষদাতার যদি সন্ধান পাও কিংবা কোনো সূত্রে যদি ধরা পড়ে, তবে তাহাকে কিছু বলিও না। ঈশ্বরের দোহাই, তাহাকে ক্ষমা করিও। যন্ত্রণাকুল ইমাম ব্যাকলভাবে অনুজকে এই পর্যন্ত বলিয়া সস্নেহ বচনে কাসেমকে বলিলেন, কাসেম, বত্স আর্শীবাদ করি তুমি চিরজীবী হও। আর বাপ। এই কবচটি সর্বদা হতে বাঁধিয়া রাখিও। যদি কখনও বিপদগ্রস্ত হও সে বিপদ হইতে রক্ষা পাইবার উপায় যদি নিজ বুদ্ধিতে কিছুতেই স্থির করিতে না পার তবে এই কবচের অপর পৃষ্ঠে লক্ষ করিও; যাহা লেখা দেখিবে সেইরূপে কার্য করিবে। সাবধান তাহার অন্যথা করিও না।
কিয়ৎক্ষণ পর নিতন্ধ থাকিয়া উপর্যুপরি তিন চারিটি নিঃশ্বাস ফেলিয়া হোসেনকে সম্বোধনপূর্বক মুমূষু হাসান পুনরায় কহিলেন, ভাই, ক্ষণকালের জন্য তোমরা সকলে একবার বাহিরে যাও। কেবল জাএদা একাকিনী এখানে উপস্থিত থাকুন। জাএদার সহিত নির্জনে আমার একটি বিশেষ কথা আছে।
সকলেই আজ্ঞা পালন করিলেন। শয্যার নিকটে জাএদাকে ডাকিয়া হাসান চুপি চুপি বলিতে লাগিলেন, জাএদা, তোমার চক্ষ হইতে হাসান এখন বিদায় হইতেছে, আর্শীবাদ করি, সুখে থাক। তুমি যে কার্য করিলে সমতই আমি জানিতে পারিয়াছি। তোমাকে বড়ই বিশ্বাস করিতাম। বড়ই ভালোবাসিতাম, তাহার উপযুক্ত কার্যই তুমি করিয়াছ। ভালো, সুখে থাক, আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম। হোসেনকেও ক্ষমা করিতে বলিয়াছি; তাহাও তুমি স্বকর্ণে শ্রবণ করিয়াছ। ভিতরের নিগূঢ় কথা যদি আমি হোসেনকে বলিতাম, তাহা হইলে যে কী অনর্থ সংঘটিত হইত, তাহা তুমি বুঝিতেই পারিতেছ। যাহা হউক আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম। কিন্তু যিনি সর্বসাক্ষী, সর্বময়, সর্বক্ষমার অধিকারী, তিনি তোমাকে ক্ষমা করিবেন কিনা বলিতে পারি না; তথাপি তোমার মুক্তির জন্য সর্বপ্রযত্নে সেই মুক্তিদাতার নিকট পুনঃপুন প্রার্থনা করিব। যে পর্যন্ত তোমাকে মুক্ত করাইতে না পারিব সেই পর্যন্ত আমি স্বর্গের সোপানে পা রাখিব না।
জাএদা অধোমুখে অশু বিসর্জন করিলেন, একটিও কথা কহিলেন না। সময়োচিত সংকেতধ্বনি শ্রবণে হোসেনের সহিত আর আর সকলেই গৃহমধ্যে পুনঃপ্রবেশ করিলেন। হাসান একে একে সকলের নিকট বিদায় লইলেন। হাসনেবানু ও জয়নাবের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া নিজকৃত অপরাধের মার্জনা চাহিলেন। শেষে হোসেনকে কহিলেন, হোসেন, এসো ভাই, জন্মের মতোন তোমার সহিত আলিঙ্গন করি। এই বলিয়া অনুজের গলা ধরিয়া সাশুনয়নে আবার বলিতে লাগিলেন, ভাই সময় হইয়াছে, ঐ মাতামহ স্বর্গের দ্বারে দাঁড়াইয়া ডাকিতেছেন। চলিলাম। এই শেষ কথা বলিয়াই ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে দয়াময় ইমাম হাসান সর্বসমক্ষে প্রাণত্যাগ করিলেন। হাসনেবানু, জয়নাব, কাসেম ও আর সকলে হাসানের পদলুণ্ঠিত হইয়া মাথা ভাঙিয়া কাঁদিতে লাগিলেন, জাএদা কাঁদিয়াছিলেন কিনা, তাহা কেহ লক্ষ করেন নাই।